Electoral College of US electoral college


যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন ও ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি

যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন ও ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি

লেখক: শান্তনু মজুমদার  |  সোমবার, ৫ নভেম্বর ২০১২, ২১ কার্তিক ১৪১৯
এই পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষটির নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আগ্রহীদের সবাই জানেন যে, মার্কিন ভোটাররা সরাসরি ভোট দিয়ে তাদের প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করেন না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন ইলেক্টোরাল, যারা কিনা তাদের দলের প্রার্থীর পক্ষে জনগণের ভোট দ্বারা নির্বাচিত। মোট কথা—আগামীকাল মঙ্গলবার লোকে বারাক ওবামা বা মিট রমনিকে সরাসরি ভোট দেবেন না, ভোট দেবেন ইলেক্টোরেটদেরকে। এই ইলেকটোরেটরা, যাদের মোট সংখ্যা ৫৩৮, একসাথে ইলেকটোরাল কলেজ নামে পরিচিত। সংখ্যাটা ৫৩৮ কেন? মার্কিন আইনসভাতে উচ্চকক্ষ সিনেটে ১০০ আসন এবং নিম্মকক্ষ হাউস অব কংগ্রেসে ৪৩৫ আসন আছে। এর সাথে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির জন্য ৩টি ধরে সারা দেশের জন্য ইলেকটোরাল কলেজের মোট ভোট হচ্ছে ৫৩৮টি।
হোয়াইট হাউসে থাকার জন্য লাগে ২৭০ ভোট। শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কার্যকর থাকা এবং ছোট স্টেটগুলো যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাতে বড় স্টেটগুলোর তুলনায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে কি না, তা নিয়ে চিন্তা ছিল। এ ছাড়া কংগ্রেস নাকি জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন, তা নিয়েও তর্ক ওঠে। এ বিষয়ে অনেক তর্ক-বিতর্কের পরে ১৮৮৭ সালের ‘কন্সটিটিউশিনাল কনভেনশনে’ মাঝামাঝি একটি ব্যবস্থা হিসাবে ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি চালু হয়। সময়ে-সময়ে নানা পরিবর্তন-পরিমার্জনসহ টিকে থাকা ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি নানামুখী সমালোচনার মধ্যে পড়ছে এবং এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
ইলেক্টোরাল কলেজের সমালোচকদের আপত্তির অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে—এতে দেশব্যাপী ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরিবর্তে স্টেটভিত্তিক ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতাই বিবেচ্য। এ ছাড়া ৫০টির মধ্যে ৪৮টি স্টেট (নেব্রাস্কা ও মেইন বাদে) এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে ইলেক্টোরাল কলেজের ক্ষেত্রে ‘উইনার টেইক অল’ নিয়ম চালু আছে। ব্যাপারটা একটু আজব বটে। কী ভাবে? ধরা যাক—নিউইয়র্ক স্টেটের কথা। এখানে আছে ২৯টি ইলেক্টোরাল ভোট। মঙ্গলবার লোকে ইলেক্টোরদেরকেই ভোট দেবে। তবে আলাদা-আলাদা করে নয়। ভোট দেয়া হবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নামের ব্যালটেই যেখানে ইলেকটরদের নাম থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে। তথাপি নির্বাচিত হবেন ইলেকটররাই! এখানেই শেষ নয়। এরপরে আছে ‘উইনার টেক অল’ নিয়ম। ধরা যাক—নিউইয়র্ক স্টেটে একজন প্রার্থী পেলেন ৫০.৫ ভাগ ভোট, অন্যজন ৪৯.৫ ভাগ। এ ক্ষেত্রে ইলেক্টোরাল কলেজের ২৯টি ভোটের ভাগাভাগি কী ভাবে হবে? ভাগাভাগিটা হবে তিন তাসের জুয়ার মধ্যে।  ‘উইনার টেক অল’! জো জিতা ওহি সিকান্দার! বিজয়ী প্রার্থীর ঘরেই চলে যাবে ২৯টি ভোট। অর্থ্যাত্, সাড়ে ৪৯ ভাগ ভোটের চার আনা দামও থাকবে না! এই নিয়মে দেশভিত্তিক সাধারণ ভোটারের ভোটে কম ভোট পেয়েও স্টেট-ভিত্তিক ইলেকটোরেট ভোট বেশি পেয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব। অতীতে ১৮৭৬, ১৮৮৮ এবং সাম্প্র্রতিককালে ২০০০ সালে এমন ঘটনা ঘটেছে। এ সব কারণে সমালোচকরা মনে করেন—ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতির মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচন-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধানতম নীতি, অর্থ্যাত্ ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতির সুস্পষ্ট ব্যতয় ঘটে।
ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতির অন্য একটি বড় সীমাবদ্ধতা হিসাবে ‘সুইং স্টেট’গুলোর মধ্যেই নির্বাচনী লড়াই মূলত সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়া এবং নির্বাচনে ‘সুইং স্টেট’গুলোর হাতেই নির্বাচনের ফল আটকে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। সুইং স্টেট কোনগুলো? যেসব স্টেটগুলোতে ভোটাররা শেষাবধি কোনো প্রার্থী বা দলের পক্ষে সুস্পষ্ট সমর্থন দেখান না, সেগুলোই হচ্ছে সুইং স্টেট। এ সব স্টেটে ভোটের সামান্য সুইং বদলে দিতে পারে পুরো চিত্র। কেননা, ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির কারণে সামান্যতম ভোট বেশি পাওয়া প্রার্থীই পেয়ে যাবেন স্টেটের জন্য বরাদ্দ সবগুলো ইলেক্টোরাল ভোট। এবার এ ধরণের স্টেটের সংখ্যা গোটা নয়েক। এগুলো হচ্ছে—ওহিও, ফ্লোরিডা, ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, কলোরাডো, নেভাদা, উইন্সকনসিন, আইওয়া ও নিউ হ্যাম্পশায়ার। এগুলোতে মোট ইলেক্টোরাল ভোট ১১০টি। অর্থ্যাত্, মোট ইলেক্টোরাল ভোটের (৫৩৮টি) বলতে গেলে পাঁচ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু হলে কি হবে? জিততে হলে তো দরকার ২৭০ টি ভোট। অর্থ্যাত্, নয়টি সুইং স্টেট জিতে নিতে পারলে ৪০ ভাগ ভোট জেতা হয়ে গেল। বাকি ৪১টি স্টেটে থেকে জিততে হবে বাকি ৬০ ভাগ।
ওবামা কিংবা রমনির দিকে তাকিয়ে দেখুন—গত কয়েক মাসে দুই প্রার্থীর যত দৌড়-ঝাঁপের বেশির ভাগই এই নয় স্টেইটে। নির্বাচনী ব্যয়, প্রচারণা, মিডিয়ার আগ্রহ—সব কিছু সুইং স্টেটগুলোকে ঘিরে। সময় যত ঘনিয়ে আসার সাথে-সাথে সুইং স্টেটগুলোর মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণগুলো বাছাই করে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। উদাহরণ—ওহিও। মাত্র ১৮টি ইলেক্টোরাল ভোট নিয়ে গত কয়েক দশক ধরে ওহিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রার্থীদের দোষ দেয়ার উপায় নেই। এবারের সুইং স্টেটগুলোর বাইরে বাকি ৪১টি স্টেটের কথা ধরা যাক। এগুলোর অনেকই ‘সেইফ স্টেট’। অর্থ্যাত্ এই ৪১ স্টেটের অনেকগুলোতেই কোনো দলের প্রার্থী জিতবে বা হারবে, তা আগে থেকেই স্পষ্ট হয়ে থাকে। ফলে যে স্টেটগুলোতে জয় নিশ্চিত কিংবা হার অবধারিত, সেগুলোর দিকে তেমন একটা মনযোগ দেয় না প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা। ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতির কারণে এভাবেই উদার-নীতিক গণতন্ত্রের প্রাণস্বরূপ যে নির্বাচন ব্যবস্থা, তা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্ অংশ জুড়ে তেমন কোনো সাড়া জাগায় না। সুইং স্টেটগুলোর তুলনায় অন্য অনেক স্টেটে নাগরিকদের মধ্যে ভোট দেয়ার হার অনেক কম থাকার অন্যতম কারণ এটাও।
দ্য ইউএস ন্যাশনাল আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর তথ্য মতে ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি বাতিল করার জন্য গত দুই শ বছরে কংগ্রেসে সাতশ-এর অধিক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু দেখাই যাচ্ছে যে, এ সবে কাজ হয়নি।

লেখক :শান্তনু মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক

No comments:

Post a Comment