ভালোবাসার সিঁড়ির মুখে প্রেমিক দম্পত্তি
লিউ জুজিয়াং তখন ১৯ বছরের টগবগে সুদর্শন এক তরুণ। খোশমেজাজি, সদালাপি। হুট করে প্রেমে পড়লেন তাঁর চেয়ে ১০ বছরের বড় বিধবা এক রমণীর।
সে আজ থেকে ৫০ বছর আগের কথা। আজকের তুলনায় তখনকার চীন wছল আরও রক্ষণশীল। প্রথামতে বয়সে বড় কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়া ছিল অনৈতিক ও নিষিদ্ধ। সেই নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল ডিঙিয়ে জুজিয়াং হাত ধরলেন সু চাওকিনের।
ঁজুজিয়াংয়ের ভালোবাসা নিয়ে চারদিকে শুরু হলো টিটকারি। স্ত্রীকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আর সইতে পারছিলেন না। ক্ষোভে-অভিমানে স্ত্রীকে নিয়ে ঘর ছাড়লেন জুজিয়াং। চলে গেলেন মনুষ্য সমাজের বাইরে, দূর পাহাড়ে।
পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিলেন নবদম্পতি। পানি নেই, খাবার নেই, নেই বিদ্যুত্। ছিল শুধু ভালোবাসা। জায়গাটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চীনের চংকিং শহরের কাছাকাছি। কালেভদ্রে নিচে নামতেন তাঁরা। শুরুর দিকে পাহাড়ি লতাপাতা ও গাছের শিকড়-বাকড় খেয়ে থাকতেন। গুহার ঘরে সূর্যের আলো ঠিকমতো পৌঁছায় না। সঙ্গে করে আনা কালির দোয়াতকে কুপি বানালেন জুজিয়াং।
সবকিছুর চেয়ে জুজিয়াং বেশি কষ্ট পাচ্ছিলেন স্ত্রীর কষ্ট দেখে। পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে উঠতে-নামতে কষ্ট হয় চাওকিনের। একদিন হাতে বানানো হাতুড়ি-বাটাল, কোদাল নিয়ে চলে গেলেন বাড়ির কাছাকাছি ঢালটায়। নেমে পড়লেন পাহাড়ি ঝোপঝাড় পরিষ্কারের কাজে। একটু জায়গা পরিষ্কার করতেই অর্ধেক দিন চলে গেল। বাকি অর্ধেক দিনে দুটো সিঁড়ির ধাপ বানাতে পারলেন। সেই থেকে শুরু।
প্রতিদিন কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই জুজিয়াং চলে যেতেন পাহাড়ের ঢালে। নিবিষ্টমনে সিঁড়ি বানাতেন। স্ত্রী তাঁর কোমল পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামবেন, আর তিনি মুগ্ধ নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখবেন। এমন স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতেন মানুষটি। দিন যায়, মাস যায়, যায় বছরের পর বছর। জুজিয়াংয়ের সিঁড়ি বানানো তবু শেষ হয় না। স্ত্রী কতবার বারণ করেছেন। কিন্তু জুজিয়াংয়ের ওই এক পাগলামো। পাহাড়ের পাদদেশ অবধি সিঁড়ি তিনি বানিয়েই ছাড়বেন। দেখতে দেখতে তাঁদের ঘর ছেলেমেয়েতে ভরে যায়। একে একে ঘর আলো করে সাতটি সন্তান আসে। একসময় তারাও বড় হয়।
কিন্তু জুজিয়াংয়ের সিঁড়ি বানানো শেষ হয় না। দীর্ঘ ৫০ বছর পর শেষ হলো জুজিয়াংয়ের সিঁড়ি বানানো। গুনে দেখা গেল, পাহাড়ের পাদদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত ছয় হাজারের বেশি ধাপ হয়ে গেছে।
২০০১ সালে ভালোবাসার সিঁড়ি বানানোর কাজ শেষ করেন জুজিয়াং। তত দিনে প্রিয়তমা স্ত্রীর নরম-কোমল পা কুঁচকে গেছে, জোর কদমে হাঁটতে পারেন না, চুলে ধরেছে পাক। বুড়িয়ে গেছেন চাওকিন। তাতে কী! তাঁর ভালোবাসা তো বুড়িয়ে যায়নি। তারুণ্যের কাঁচা সেই দিনগুলোর মতো এখনো সবুজ আছে তাঁর মন। বুড়ো জুজিয়াংয়ের হাত ধরে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলেন চাওকিন।
পাকেচক্রে সে বছরই একদল অভিযাত্রীর চোখে পড়ল সিঁড়িগুলো। খুঁজতে খুঁজতে বুড়ো-বুড়ি আর তাঁদের ছেলেমেয়েদের দেখা পেল দলটি। সেই প্রথম সভ্য জগতের মানুষ জানল ছয় হাজার সিঁড়ি তৈরির পেছনে অমর এক প্রেমকাহিনির কথা।
২০০৬ সালে ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে চায়নিজ উইমেন উইকলি কাহিনিটি প্রথম প্রকাশ করে। চীনে তো বটেই, সাড়া পড়ে যায় দুনিয়াজুড়ে। প্রেমিক যুগলের প্রতি সরকারেরও নেকনজর পড়ে। স্থানীয় সরকার ঘোষণা দেয়, ওই সিঁড়ি তারা রক্ষণাবেক্ষণ করবে, বাড়িতে বিদ্যুত্ পৌঁছে দেবে। আর তাঁদের বাড়িটিকে জাদুঘর বানানো হবে।
এক বছর পরের কথা। জুজিয়াংয়ের বয়স তখন ৭২। হঠাত্ একদিন বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। স্ত্রীকে কাছে ডাকলেন। হাতখানা মুঠোয় পুরে গাঢ় দৃষ্টিতে স্ত্রীর চোখে চোখ রাখলেন। বললেন, ‘চললাম। ভালো থেকো।’ সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে। চাওকিন অশ্রুসজল চোখে স্বামীর প্রতি অভিযোগ তোলেন, ‘তুমি বলেছিলে সব সময় আমার পাশে থাকবে। কিন্তু তুমি কথা রাখবে না কেন! এখন আমি একা একা কী করে থাকি!’
তাজমহল গড়তে শাহজাহানের হাত নয়, লেগেছে হাজার হাজার শ্রমিকের শক্ত পেশিবহুল হাত। ঝরেছে ঘাম আর কত শত শ্রমিকের রক্ত।
জুজিয়াং কোনো সম্রাট নন। কিন্তু ভালোবাসার বিবেচনায় কি শাহজাহানের চেয়ে পিছিয়ে আছেন তিনি?
No comments:
Post a Comment