বাণিজ্যের আড়ালে মানি লন্ডারিং

ফারুক মঈনউদ্দীন | আপডেট: ০০:১৪, মার্চ ০৫, ২০১৬ | প্রিন্ট সংস্করণ   Main link


ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির ফিন্যান্স বিভাগের প্রফেসর জন জানোউইচ মায়ামি হেরাল্ড পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একটা মজার মন্তব্য করেছিলেন, ‘মানি লন্ডারিংয়ের সদর দরজা হচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা...সরকার এই দরজা বন্ধ করে খুব ভালো একটা কাজ করেছে, কিন্তু পেছনের দরজাটি, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হাট করে খোলা।কথাটা কেবল আমাদের দেশের জন্য নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্যও প্রযোজ্য

আমাদের দেশের বিদ্যমান আইনে মানি লন্ডারিং বলতে আমরা বুঝি অপরাধের আয়ের অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা নিয়ন্ত্রণ গোপন করা। অথবা অপরাধ সংঘটনে জড়িত ব্যক্তিকে আইনগত ব্যবস্থা থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সহায়তা করার জন্য অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত সম্পত্তি জ্ঞাতসারে স্থানান্তর, রূপান্তর বা হস্তান্তর করা, বিদেশে পাঠানো বা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আনা বা বৈধ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি বিদেশে পাচার করা। এই সংজ্ঞায় সম্পৃক্ত অপরাধের তালিকা আরও দীর্ঘ, সীমিত পরিসরে যার বিস্তারিত পরিবেশনা কঠিন
আমাদের ব্যাংকগুলো যখন স্থানীয়ভাবে মানি লন্ডারিং বন্ধ করার জন্য নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা নিশ্চিত করছে, তখনো অরক্ষিত রয়ে গেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ পাচারের প্রশস্ত পথটি। অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায় নগদ অর্থ কিংবা চেকের মাধ্যমে লেনদেন করে টাকা ধোলাইয়ের বিষয়টির ছোটখাটো ফাঁকফোকর বন্ধ করার চেষ্টায় কিছুটা সাফল্য অর্জিত হলেও আন্তর্জাতিক অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচারের সুযোগ এখনো অবারিত থাকায় এটি একটি কাঙ্ক্ষিত মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সে জন্য প্রয়োজন দেখা দিয়েছে ব্যাপক পরিকল্পনা কর্মসূচির। কারণ, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের পরিমাণ পরিধি বেড়ে যাওয়া এবং তথ্যপ্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধিত হওয়ায় এই প্রক্রিয়ায় মানি লন্ডারিং এবং অর্থ পাচারের সুযোগ সম্ভাবনাও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে
 বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালে বৈশ্বিক আমদানির পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৩ সালে এসে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর ধারণা, কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অর্থ পাচারের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে গেছে
বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং বলতে আমরা বুঝি অবৈধ অর্থ বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে বৈধ করার চেষ্টা করা বা উত্সকে গোপন করা, কিংবা বাণিজ্যিক লেনদেনের কারচুপির মাধ্যমে আয়ের উৎস সৃষ্টি করে সেই অবৈধ আয়কে বৈধ করার চেষ্টা করা। সাধারণ অর্থে মানি লন্ডারিংয়ের যে তিনটি প্রক্রিয়া (প্লেসমেন্ট, লেয়ারিং ইন্টিগ্রেশন) আছে, বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিংও এই তিন প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়। ক্ষেত্রেও অবৈধ অর্থ দিয়ে কোনো পণ্য কিনে সেটিকে সম্পদে পরিণত করে (প্লেসমেন্ট), তারপর সেই লেনদেনকে আড়াল করার জন্য অন্যের কাছে বা ভিনদেশে বিক্রি করে অবৈধ আয়কে জায়েজ করার চেষ্টা করে (লেয়ারিং) এবং সবশেষ পর্যায়ে সেই পণ্য আবার বিক্রি করে বিক্রিলব্ধ আয়কে সাদা করে আর্থিক ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা (ইন্টিগ্রেশন) হয়
সাধারণভাবে বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং ঘটে ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের মূল কৌশলই আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং। অবৈধ অর্থ পাচার নিয়ে গবেষণাকারী ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) মতে, মিথ্যা ইনভয়েসিং করা হয় যেসব কারণের জন্য, তার মধ্যে নিচের কারণগুলো প্রধান:
অপরাধী কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের অপরাধ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদকে বৈধতা দেওয়ার জন্য মানি লন্ডারিং করা, আমদানি করা পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে কাস্টম ডিউটি এবং অন্যান্য রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া, নির্দিষ্ট পণ্য রপ্তানির বিপরীতে রপ্তানিকারকদের যে আর্থিক বা অন্যান্য প্রণোদনা দেওয়া হয় অন্যায়ভাবে তার সুবিধা গ্রহণ করা, দেশের বিদ্যমান আইনে বিদেশে পুঁজি পাঠানো নিষিদ্ধ থাকলে সেই আইনকে পাশ কাটিয়ে দেশের বাইরে পুঁজি পাচার করা ইত্যাদি
বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি এমন অভিমত ব্যক্ত করে যে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার করার জন্য মিথ্যা ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিংই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পন্থা। এভাবে অর্জিত অর্থ অন্যান্য বৈধ আয়ের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে টাকা ধোলাইকারীরা মূল অপরাধলব্ধ আয়কে গোপন করার প্রয়াস পায়। উদাহরণ হিসেবে জিএফআই ২০১৩ সালে সোসাইটি জেনারেল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়া লেবানিজ কানাডিয়ান ব্যাংকের কথা উল্লেখ করে। ব্যাংকটি হিজবুল্লাহ গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কিত একটা মাদক পাচার চক্রের ইউরোপে গাড়ি বিক্রির অর্থের সঙ্গে আফ্রিকায় কোকেন বিক্রির টাকা মিলিয়ে লেয়ারিং প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিল। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ব্যাংকটি ১০ কোটি ডলার জরিমানা দেয় মাদক নিয়ন্ত্রণ দপ্তর অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে। ছাড়া এইচএসবিসি, ওয়াকোভিয়াসহ আরও কয়েকটা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যাংককে একই কারণে গুনতে হয়েছে বড় অঙ্কের জরিমানা
জিএফআইয়ের সর্বশেষ (২০০৪-২০১৩) প্রতিবেদনে হিসাব করা হয়েছে, এই ১০ বছরে উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে দশমিক ট্রিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে চলে গেছে উন্নত দেশগুলোয়। বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিংয়ের প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে বহুল ব্যবহৃত হয় মিথ্যা (অতি বা অবমূল্যায়িত) ইনভয়েসিং, অতিরিক্ত ঘোষিত মূল্যের চেয়ে কম বা বেশি জাহাজীকরণ, পণ্যের মিথ্যা বিবরণ, একাধিক ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পণ্যমূল্যকে ফাঁপিয়ে তোলা
স্মর্তব্য, দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাংলাদেশের অনেক দুর্নীতির মধ্যে একওপেন সিক্রেটআন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেছিল। নিবন্ধে দুর্নীতিটির প্রতি দাতা সংস্থার সীমিত মনোযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে যে পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়, সেটা রোধ করা গেলে সরকারের খরচ করার সক্ষমতা দ্বিগুণ হতো, যাতে প্রতি দুই বছরে পদ্মা সেতুর মতো একটা করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত। নিবন্ধটিতে বাংলাদেশের একসময়ের অর্থ বাজার উপদেষ্টা ফরেস্ট কুকসনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের এই দৌরাত্ম্য বন্ধ করা গেলে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত দশমিক শতাংশ বাড়ানো সম্ভব। অথচ গত এক দশকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বেড়ে চার গুণ হলেও আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো বিশ্বের মধ্যে নিম্নতম
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে গঠিত আন্তসরকার সংগঠন ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং চিহ্নিত করার জন্য দীর্ঘ তালিকার দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যেমন: . বিল অব ল্যাডিং ইনভয়েসে বর্ণনার সঙ্গে জাহাজীকরণ করা পণ্যের মধ্যে যথেষ্ট গরমিল, . ইনভয়েসের পণ্যমূল্য এবং বাজারমূল্যের মধ্যে বড় পার্থক্য, . কাস্টমস ঘোষণার সঙ্গে অন্যান্য ডকুমেন্টে উল্লেখিত মূল্যের মধ্যে পার্থক্য, . রপ্তানি বন্দর, জাহাজীকরণের শর্তাবলি অথবা পণ্যের বিবরণ এলসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়া, . আমদানি বা রপ্তানিকারকের নিয়মিত ব্যবসার সঙ্গে আমদানি পণ্যের অসামঞ্জস্য, কিংবা ব্যবসার পরিমাণের ধারাবাহিকতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এমন পরিমাণে পণ্য আমদানি বা রপ্তানি করার প্রবণতা, . প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, রাসায়নিক পদার্থ, অপরিশোধিত তেল ইত্যাদি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যের বাণিজ্যের সঙ্গে আকস্মিক সংশ্লিষ্টতা, . কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া পণ্য ট্রান্সশিপমেন্ট করা (দ্বিতীয় কোনো বন্দরে পুনর্জাহাজীকরণ), . অতি নগণ্য মূল্যের পণ্যের জন্য বড় কনটেইনার ব্যবহার করা, . অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেন, যেমন নতুন বিক্রেতাকে আগাম মূল্য পরিশোধ করে দেওয়া, ১০. ক্রেতা বা বিক্রেতার সঙ্গে সম্পর্কবিহীন তৃতীয় পক্ষের তরফে মূল্য পরিশোধ কিংবা তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে লেনদেন করা, ১১. বারবার এলসিতে পরিবর্তন এবং যৌক্তিক কারণ ছাড়া সময় বাড়ানো, ১২. অস্তিত্ববিহীন নামসর্বস্ব কোম্পানি গঠন করে সেই কোম্পানির মাধ্যমে লেনদেন করা, ১৩. পণ্য মূল্য লেনদেনের প্রক্রিয়াকে অহেতুক জটিল করে ব্যবসা করা ইত্যাদি
এতগুলো বিষয়ের ওপর লক্ষ রাখার কাজটি এককভাবে ব্যাংকের ওপর বর্তায় না এবং সম্ভবও নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিংয়ের ওপর নজরদারি করার মতো আরও অনেক সংস্থা প্রতিষ্ঠান থাকলেও এখন পর্যন্ত এই গুরুদায়িত্ব ব্যাংকের ওপরই ন্যস্ত। ফলে বিষয়টা একদিকে যেমন বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোর মতো হয়ে গেছে, অন্যদিকে প্রতিরোধব্যবস্থা শিথিল থাকার কারণে পুরো মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়ার অনেক স্তরের মধ্যে একটিমাত্র ক্ষেত্রের রক্ষক হিসেবে ব্যাংকগুলো পড়ে আছে ঝুঁকির মুখে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকটা ব্যাংকের ওপর আরোপিত বিশাল দণ্ড থেকেই এই ধারণার সত্যতা মেলে। আমাদের কঠোর বৈদেশিক মুদ্রা আইন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইন থাকা সত্ত্বেও একশ্রেণির মানুষের বিদেশে সম্পত্তি কেনার বিষয়টি কিংবা সে উদ্দেশ্যে অর্থ স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। আশার বিষয়, মাত্র কয়েক দিন আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আমাদের মানি লন্ডারিংয়ের ৮০ শতাংশ যে বাণিজ্যভিত্তিক, সে কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন এক আন্তবিভাগীয় সভায়। এই উপলব্ধির সূত্র ধরে বাণিজ্যের আড়ালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সব মহলের অংশগ্রহণে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সদর দরজা বন্ধ করলেও সম্পূর্ণ অরক্ষিত থেকে যাবে পেছনের দরজা
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক  ব্যাংকার৷

fmainuddin@hotmail.com

No comments:

Post a Comment